একমুঠো জোনাকী – পুর্ণেন্দু পত্রী

একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
একমুঠো জোনাকীর আলো পেয়ে
এক একটা যুবক হয়ে যাচ্ছে জলটুঙি পাহাড়
যুবতীরা সুবর্ণরেখা।
সাপুড়ের ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী
পুজো সংখ্যা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী।
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
ময়দানের মঞ্চে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে
জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল যেন কারা।
রবীন্দ্রসদনে তিরিশজন কবি তিরিশদিন ধরে আউড়ে গেল
একমুঠো জোনাকীর সঙ্গে তাদের ভাব-ভালোবাসা।
ইউনেসকোর গোল টেবিল ঘিরে বসে গেছে মহামান্যদের সভা
একমুঠো জোনাকীর আলোয়
আফ্রিকা থেকে আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত হোগলা বন আর ফাটা দেয়ালে
সাজিয়ে দেবে কোনারক কিংবা এথেন্সের ভাস্কর্য।
সাত শতাব্দীর অন্ধকার এইভাবে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজি দেখিয়ে চলেছে একমুঠো জোনাকীর আলোয়।

স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল – পুর্ণেন্দু পত্রী

পুরনো পকেট থেকে উঠে এল কবেকার শুকনো গোলাপ ।
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই ।

স্মৃতি কি আমারও আছে ? স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত, লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত থাকে গান, আলাপচারীতা ?

আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল, দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি, ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়, গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী ।

আকাঙ্খার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের অভ্রে ও আবীরে
আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের ভিতরের নীলে ।

স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর ।
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল কিছুতে বলবে না ।

কথোপকথন – ২১ – পুর্ণেন্দু পত্রী

-তোমাদের ওখানে এখন লোডশেডিং কি রকম?
-বোলো না। দিন নেই, রাত নেই, জ্বালিয়ে মারছে।
-তুমি তখন কী করো?
-দরজা খুলে দিই
জানালা খুলে দিই
র্প দা খুলে দিই।
আজকাল হাওয়াও হয়েছে তেমনি ফন্দিবাজ ।
যেমনি অন্ধকার, অমনি মানুষের ত্রিসীমানা ছেড়ে দৌড়
-তুমি তখন কি করো?
-গায়ে জামা-কাপড় রাখতে পারি না।
সব খুলে দিই,
চোখের চশমা, চুলের বিনুনি, বুকের আঁচল লাজ-লজ্জ্বা সব ।
-টাকা থাকলে তোমার নামে ঘাট বাঁধিয়ে দিতুম কাশী মিত্তিরে
এমন তোমার উথাল – পাতল দয়া।
তুমি অন্ধকারকে সর্বস্ব, সব অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খুলে দিত পার কত সহজে।
আর শুভঙ্কর মেঘের মত একটু ঝুঁকলেই
কি হচ্ছে কি?
শুভঙ্কর তার খিদে- তেষ্টার ডালপালা নাড়লেই
কি হচ্ছে কি ?
শুভঙ্কর রোদে – পোড়া হরিণের জিভ নাড়লেই
কি হচ্ছে কি?
পরের জন্মে দশদিগন্তের অন্ধকার হব আমি।

নিষিদ্ধ ভালোবাসার তিন সাক্ষী – পুর্ণেন্দু পত্রী

তুমি যখন শাড়ির আড়াল থেকে
শরীরের জ্যোৎস্নাকে একটু একটু করে খুলছিলে,
পর্দা সরে গিয়ে অকস্মাৎ এক আলোকিত মঞ্চ,
সবুজ বিছানায় সাদা বাগান,
তুমি হাত রেখেছিলে আমার উৎক্ষিপ্ত শাখায়
আমি তোমার উদ্বেলিত পল্লবে,
ঠিক তখনই একটা ধুমসো সাদা বেড়াল
মুখ বাড়িয়েছিল খোলা জানালায়।

অন্ধকারে ও আমাদের ভেবেছিল
রুই মৃগেলের হাড় কাঁটা।
পৃথিবীর নরনারীরা যখন নাইতে নামে আকাঙ্খার নদীতে
তখন রুই মৃগেলের চেয়ে আরো কত উজ্জ্বল
দীর্ঘশ্বাস সহ সেই দৃশ্য দেখে বেড়ালটা ফিরে চলে গেলো
হাড়কাঁটার খোঁজে অন্য কোথা অন্য কোনখানে।
দ্বিতীয় সাক্ষী ছিল তোমার হত্যাকারী চোখ
আর তৃতীয় সাক্ষী আমার রক্তের সঙ্গে ওতপ্রোত শুয়ে আছে।

কথোপকথন – ৭ – পুর্ণেন্দু পত্রী

– দেখ, ওই কচুপাতার ওপর জমে থাকা পানি
কী স্বচ্ছ, আর কেমন স্থির!
গতরাতের বৃষ্টির পরে
যতটুকু জল গড়িয়ে পড়লো নদী বা পুকুরে 
তার থেকে ঢের স্বল্প হয়েও দৃষ্টিকারে
যেন জলের সৌন্দর্য মুক্তোর মত হবে…
– আমিও বেশ দেখি, বৃষ্টির পরে 
সবুজে চোখ ফিরিয়ে আনি; সেদিন যখন
দৃষ্টিসীমায় পেয়ে গেছি কচুপাতা আশ্চর্য!
সে পাতাটায় জল ছিল না জানো?
তবে মুক্তোর মত মনে হলেও 
ওই জলোমুক্তোয় মালা হবে না জেনো।
– বুঝলাম! মালা গাঁথবার স্বাদ
সে কখনও হয়নি আমার তবু
যদি কখনও গাঁথবার আকাঙ্খা পেয়ে বসে তখন
তোমার কথা যা হারিয়ে যাচ্ছে, যায় ক্রমাগত
তাকেই উপকরণ করে নেবো মালা গেঁথে…
– হু! কতহাজার জনের কতশত মালা, বুঝবে?
বুঝবে কোনটা কার?
– বুঝতে চাইব কেন?
যাকে চিনি না কিংবা যে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে
তাকে আর কেন হাতরিয়ে খোঁজা
মনের শত আকাশে আকাশে
কেন বল তবে পিচ্ছলে পড়া!
– পিচ্ছলে তুমি পড়বে মনে রেখো..
– না পড়লে হাত বাড়াবে কে, বল!
– থাক বাবা আর না, ওই কচুপাতাটা আনো
দেখো জল যেন না পড়ে যায়, সাবধানে- হ্যাঁ
– জল ধরে রাখবার ইচ্ছে আমার প্রবল 
সে তুমি জানো, আর তাতেই দু’জনের তৃপ্তি 
– তুমি না-অসভ্য!